পুরো অর্থব্যবস্থাকে যদি একটি বিশাল হিমশৈল বা আইসবার্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়, তবে আমাদের পকেটে থাকা টাকা বা মুদ্রা হলো সেই হিমশৈলের পানির ওপরে ভেসে থাকা সামান্য চূড়ামাত্র। ছোটবেলায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড-মিরেরসরাই এলাকায় বেড়ে ওঠার সুবাদে আঞ্চলিক ভাষার ‘মানি’ শব্দটির সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলাম। সেখানে ‘মানে’ বা অর্থ বোঝাতে ‘মানি’ বলা হতো, যা ইংরেজি ‘Money’ শব্দের উচ্চারণের খুব কাছাকাছি। তখন ভাবতাম ‘অর্থ’ মানেই বুঝি ‘টাকা’। কিন্তু বড় হয়ে জানলাম, বাংলা ভাষায় আমরা ‘অর্থ’, ‘টাকা’ বা ‘মুদ্রা’ শব্দগুলো একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাৎ রয়েছে। যেমন ‘টঙ্ক’ বা রৌপ্য মুদ্রা থেকেই ‘টাকা’ শব্দের উৎপত্তি, যা অনেকটা হিন্দি বা উর্দু ‘রুপায়া’র সমার্থক। পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনীতেও বঙ্গ অঞ্চলে ‘দিনার’-এর বদলে ‘টাকা’ ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে অর্থনীতির ভাষায় ইংরেজি ‘মানি’ (Money) এবং ‘কারেন্সি’ (Currency)-র ধারণা এক নয়। রোমান দেবী ‘মনেতা’-র নামানুসারে ‘মানি’ শব্দের উৎপত্তি, যেখানে কারেন্সি এসেছে ল্যাটিন শব্দ থেকে যার অর্থ ‘দৌড়ানো’। অর্থাৎ যা হাতবদল হয়ে চলে, তাই কারেন্সি বা প্রচলিত মুদ্রা।
অর্থনীতির ভাষায় টাকার নানা রূপ
অর্থনীতির পরিভাষায় অর্থের কয়েকটি স্তর রয়েছে। আমাদের হাতে যে নগদ টাকা বা কারেন্সি থাকে, তাকে বলা হয় এম-ওয়ান (M-1)। ব্যাংকে জমা থাকা অর্থ হলো এম-টু (M-2), আর ব্যাংক যখন কাউকে ঋণ দেয়, সেই অর্থকে বলা হয় এম-থ্রি (M-3)। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংক যদি আপনাকে এক কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে, তবে সেই বিশাল অংকের টাকা কিন্তু স্যুটকেসে ভরে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হয় না। সেই টাকা ব্যাংকের হিসেবেই থাকে, যা কেবল সংখ্যায় বিদ্যমান। এই এম-টু বা এম-থ্রি অর্থের কোনো দৃশ্যমান রূপ নেই, এগুলো কেবলই সংখ্যা। অথচ প্রয়োজন হলে আপনি চেক বা কার্ডের মাধ্যমে সেই অদৃশ্য অর্থ ব্যবহার করতে পারেন। যখন এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলেন, তখনই কেবল সেই অদৃশ্য সংখ্যাটি এম-ওয়ান বা কাগজের নোটে রূপান্তরিত হয়ে আপনার হাতে আসে।
ডিজিটাল লেনদেনে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নতুন সিদ্ধান্ত
এই যে অদৃশ্য অর্থ বা ডিজিটাল লেনদেনের কথা বলা হচ্ছে, আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের বৃহত্তম ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) তাদের ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে। ব্যাংকটি জানিয়েছে, আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২৫-এর পর থেকে তাদের অনলাইন এসবিআই এবং ইয়োনো লাইট (YONO Lite) অ্যাপে ‘এম-ক্যাশ’ (mCASH) সুবিধাটি আর পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ, গ্রাহকরা এরপর থেকে বেনিফিশিয়ারি বা প্রাপকের অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টাকা পাঠানো বা এম-ক্যাশ লিঙ্কের মাধ্যমে অর্থ দাবি করার সুযোগটি হারাবেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে গ্রাহকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন এখন থেকে টাকা স্থানান্তরের জন্য অন্যান্য নিরাপদ ও বহুল প্রচলিত মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেন।
বিকল্প ব্যবস্থা ও ব্যবহারের নিয়মাবলি
এসবিআই তাদের ওয়েবসাইটে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এম-ক্যাশ সুবিধা বন্ধ হয়ে গেলেও গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তারা ইউপিআই (UPI), আইএমপিএস (IMPS), এনইএফটি (NEFT) বা আরটিজিএস (RTGS)-এর মতো মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে খুব সহজেই তৃতীয় পক্ষের কাছে টাকা পাঠাতে পারবেন। যারা স্মার্টফোনের মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন করতে চান, তাদের জন্য ‘ভিম এসবিআই পে’ (BHIM SBI Pay) একটি চমৎকার বিকল্প। এটি ব্যবহার করে যেকোনো ব্যাংকের গ্রাহকের সঙ্গে টাকা লেনদেন, বিল পরিশোধ, রিচার্জ এবং কেনাকাটা করা সম্ভব।
এই অ্যাপটি ব্যবহারের প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। প্রথমে অ্যাপটি খুলে নিজের অ্যাকাউন্টে লগ-ইন করতে হবে। এরপর হোম স্ক্রিনে থাকা ‘পে’ (Pay) অপশনে ক্লিক করতে হবে। টাকা পাঠানোর জন্য ভিপিএ (VPA), অ্যাকাউন্ট নম্বর ও আইএফএসসি কোড ব্যবহার করা যাবে অথবা কিউআর কোড স্ক্যান করেও পেমেন্ট করা যাবে। প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়ার পর নিজের লিংক করা অ্যাকাউন্টটি নির্বাচন করে টিক চিহ্নে চাপ দিতে হবে। সবশেষে ইউপিআই পিন নম্বর দিয়ে লেনদেনটি নিশ্চিত করলেই কাজ শেষ। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাগুজে নোটের ব্যবহার কমছে এবং ডিজিটাল লেনদেনের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা অর্থের আধুনিক বিবর্তনেরই এক বাস্তব চিত্র।