বাংলাদেশে বাংলা ক্যালেন্ডারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ফলে কিছু জাতীয় দিবস ও বাংলা মাসের তারিখে পরিবর্তন এসেছে। এখন থেকে বাংলা নতুন বছরের প্রথম ছয়টি মাস হবে ৩১ দিনের এবং পয়লা বৈশাখসহ অন্যান্য দিবস নির্দিষ্ট দিনেই উদযাপিত হবে।
পরিবর্তনের মূল দিকগুলো
নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন—এই ছয়টি মাস হবে ৩১ দিনের। ফাল্গুন মাস থাকবে ২৯ দিনের, তবে লিপইয়ার হলে একদিন বাড়িয়ে ৩০ দিন করা হবে। আগে শুধুমাত্র বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত পাঁচটি মাস ৩১ দিনে গণনা হতো, এখন এই নিয়ম আরও বিস্তৃত হয়েছে।
এ সংস্কারের ফলে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবসগুলো যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর বাংলা ক্যালেন্ডারের নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী উদযাপিত হবে, যেগুলো এই ক্যালেন্ডারে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পয়লা বসন্তের নতুন সময়
আগে পয়লা বসন্ত অর্থাৎ ফাল্গুন মাসের প্রথম দিন উদযাপিত হতো ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু নতুন ক্যালেন্ডার অনুসারে এই দিনটি এখন থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে পালন করা হবে। এর ফলে বাংলা ক্যালেন্ডার ও ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মধ্যে সমন্বয় আরও দৃঢ় হলো।
সংস্কারের পেছনের উদ্যোগ
বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন, অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ এই বর্ষপঞ্জি সংস্কারের কাজ করেছে। একাডেমির পরিচালক মোহাম্মদ মোবারক হোসেন জানিয়েছেন, বাংলা ও ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এই সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৫ সালে, যখন বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ছিলেন ড. অজয় রায়, জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো বিজ্ঞজনেরা।
ঐতিহাসিক পটভূমি
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হয় ভারতে ১৯৫২ সালে। প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, যিনি বাংলাদেশের সন্তান, তার নেতৃত্বে ভারতের সরকার একটি পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিতে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কারের সুপারিশ করে, যা পরবর্তীতে বাস্তবায়িত হয়।
বাংলাদেশেও একই পথে হেঁটে ১৯৫৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কিছু প্রস্তাব দেন, যার ভিত্তিতে এই নতুন সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে।
বাংলা সনের সূচনা
ইতিহাস বলছে, বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল ১৫৫৬ সালে, মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে তার সভার জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লা শিরাজীর সহায়তায় তিনি ‘তারিখ-ই-এলাহি’ নামক বর্ষপঞ্জি চালু করেন। এটি কৃষকদের মধ্যে পরিচিতি পায় ‘ফসলি সন’ নামে, যা পরবর্তীতে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ রূপে পরিচিত হয়ে ওঠে।
সেই সময় প্রচলিত ছিল হিজরি সন, যা চান্দ্র হিসেবে গণনা হওয়ায় কৃষির সঙ্গে মিলিয়ে রাজস্ব আদায় কঠিন ছিল। নতুন এই সৌর নির্ভর বর্ষপঞ্জির মাধ্যমে তা সহজ হয়।
বাংলা সনের গণনা শুরু হয় ৯২৩ হিজরি সন থেকে, অর্থাৎ তা শূন্য থেকে শুরু হয়নি। এছাড়া বাংলা মাসগুলোর নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে, যা এর জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ভিত্তিকে তুলে ধরে।
উপসংহার
বাংলা ক্যালেন্ডারের এই পরিবর্তন শুধু সময় নির্ধারণে নয়, বরং জাতীয় পর্যায়ে দিনপঞ্জির মাধ্যমে ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি বড় পদক্ষেপ। এই সংস্কারের মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতি ও সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বয় গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।